ফিরে দেখা কিছু প্রিয়, অপ্রিয়, বিচিত্র অভিজ্ঞতা; বৈশাখের কথা মনে পড়লে যেমন ফিরে যাই রমনার বটমূলে, তেমনই আবার লুকিয়ে যাই কিছু পরিবর্তিত ধারার আড়ালে।
তখন আর কতোইবা বয়স , পাঁচ কি ছয় ! সূর্য তখনও উঁকি দেয়ার ঝুঁকি নেয়নি অথচ আমাকে আম্মা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলেন ! চোখ কচলাতে কচলাতে দেখলাম , সেজ জেঠিমা আর ছোট ফুপু লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরায় ব্যাস্ত । আম্মাও আলমারি থেকে লাল পেড়ে গরদের শাড়িটা বের করলো আর আমাকে একটা সাদা ফ্রক দিলো পরিয়ে । তখনও জানিনা এমন অন্ধকারে সেজে গুজে কোথায় চলেছি ! সবার সাজগোজ সারা হতেই বেরিয়ে পরলাম!
গেইটের বাইরে যেয়ে দেখলাম দুটো রিকশা দাঁড়িয়ে আছে ! রাতেই বলা ছিলো বোধ হয় । আমাদের বাড়ি ছিলো পুরান ঢাকায় ! বাড়ির উল্টো পাশেই বড় একটা রিকশার গ্যারেজ ছিলো । আম্মা আর চাচী উঠলো এক রিকশায় , অন্যটায় আমি আর ছোট ফুপু ! গন্তব্য কোথায় জানিনা , তবে মনে মনে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম এটাতো বলার অপেক্ষা রাখেনা । খালি রাস্তায় রিকশা ছুটে চলেছে ! ফুপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন ।
বললাম : আমরা কোথায় যাচ্ছি ফুপু ?
ফুপু হেসে বললেন , এটাইতো সারপ্রাইজ ! আগে থেকে বলে দিলে মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে ।
ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি আমরা ! তখনও আলো ফোটেনি ! দেখলাম রমনা পার্কের গেইট এর সামনে এসে রিকশা থামলো । ভাবলাম , এটা কোনো সারপ্রাইজ হলো? এই পার্কে তো আব্বা আম্মার সাথে কতোবার এসেছি ।
যাই হোক হেঁটে গিয়ে বটতলায় যখন পৌঁছুলাম তখন দেখলাম ছায়ানটের যতো চেনা মানুষেরা সব লাল সাদা শাড়ি আর পাঞ্জাবী পায়জামা পরে সারি বেঁধে বসে আছে সমস্ত বাদ্য যন্ত্র নিয়ে । আমার আম্মা , ফুপু এবং চাচী তিনজনই ছায়ানটের ছাত্রী ! আম্মা আমাকে প্রায়ই সাথে নিয়ে যান । ওঁদের যখন ক্লাস চলতো তখন আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম, ওখান থেকেই আমার গান শেখার আগ্রহ তৈরী হয় ।
যাই হোক , আমি সব দেখে শুনে যারপরনাই আপ্লুত ! আমাকে আম্মা দর্শক সারির একদম সামনে বসিয়ে দিলেন আর বার বার শাঁসালেন যেনো কোনো ভাবেই জায়গা ছেড়ে না উঠি । আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম । দেখলাম আমাকে দর্শক সারিতে বসিয়ে দিয়ে ওরা তিনজনও আসন গ্রহন করলেন স্টেজে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে । এতোক্ষনে সারপ্রাইজটা ধরতে পারলাম । মনে মনে কি যে আনন্দ হচ্ছিলো আমার পরিবারের সবাই আজ গান গেয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে অন্য সবার সথে !
এসো হে বৈশাখ গানটি দিয়ে শুরূ হয়ে গ্যালো বর্ষ বরণের অনুষ্ঠান । একটা কমলা রঙের নরম আলো ছড়িয়ে বছরের নতুন সূর্য উদিত হলো যখন তখন পেছনে তাকিয়ে দেখি শত শত লোকের ভিড় জমে গ্যাছে ।
লাল সাদার কেতন উড়ছে তখন সারা রমনা পার্ক জুড়ে । এমন ভোর এর আগে কোনোদিন দেখিনি আমি ।
অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন পার্কের ভেতর মেলা বসেছে নানা রকম মাটি দিয়ে তৈরী খেলনা , পুতুল আর বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা পাখি আর বাঁশির । ওখান থেকে মাটির পুতুল আর খেলনা কিনে এক রাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন ।
আমার জন্মেরও অনেক বছর আগে থেকে অর্থাৎ ১৯৬৫ সাল থেকেই ছায়ানটের এই বর্ষ বরন অনুষ্ঠান শুরূ হয় । পরবর্তী কালে আমিও রমনার বটমূলে বসে কতোবার যে গান গেয়ে ছায়ানটের শিল্পীদের সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি তার হিসেব নেই । কারন আমি সাত বছর বয়সেই ছায়ানটে ভর্তি হই । তারপরের গল্প ইতিহাস । আশির দশকে চারুকলার মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রথমটিতে অংশ নিয়েছিলাম । পান্তা ভাত , ইলিশের স্টলগুলোও তখন থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরূ করলো ।
পহেলা বৈশাখের সেই বোমা বিস্ফোরণেরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমি । তখন আমার বড় মেয়ে জয়িতা খুব ছোট । ওকে খাইয়ে দাইয়ে আম্মার জিম্মায় রেখে আমি, আমার বর আর ভাইদের সাথে গেলাম বটমূলের বর্ষবরন অনুষ্ঠান দেখতে । কিছুক্ষণ অনুষ্ঠান দেখেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । ছোট বাচ্চা বাসায় রেখে এসেছি একারনেই বের হয়ে আসলাম । রমনা পার্কের গেইট পর্যন্ত আসতেই পেছন থেকে বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দ কানে এলো । থেমে গেলো গান । কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম আমরা । চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি , আর্তনাদে ভরে উঠেছিলো সেদিনের আকাশ ।
পেছন থেকে কেউ একজন বলছে ..পালান , ওরা বোমা মেরেছে ।
আমরাও উদভ্রান্তের মতো জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম । মনে হলো আমার ছোট্ট মেয়েটাই যেনো বাঁচিয়ে দিয়েছিলো আমাদের । ওর জন্যই আমরা আর্লি ফিরে যাচ্ছিলাম বাসায় । তখন আমাদের পাশ দিয়েই ভ্যানে করে রক্তাক্ত আহত মানুষদের নিয়ে যাচ্ছিলো ঢাকা মেডিকেলে ।
সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ! না, আজ এই বর্ষবরণের প্রাক্কালে সবার মন খারাপ করে দেয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না আমার । এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যেনো কারো জীবনে কখনও না হয়, আর এর পুনরাবৃত্তিও যেনো না হয় এটাই কামনা । নতুন বছর সবার জীবনে নিয়ে আসুক এক নতুন প্রভাত ।