বিংশ শতাব্দীর বৈশাখ

ফিরে দেখা কিছু প্রিয়, অপ্রিয়, বিচিত্র অভিজ্ঞতা; বৈশাখের কথা মনে পড়লে যেমন ফিরে যাই রমনার বটমূলে, তেমনই আবার লুকিয়ে যাই কিছু পরিবর্তিত ধারার আড়ালে।

তখন আর কতোইবা বয়স , পাঁচ কি ছয় ! সূর্য তখনও উঁকি দেয়ার ঝুঁকি নেয়নি অথচ আমাকে আম্মা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলেন ! চোখ কচলাতে কচলাতে দেখলাম , সেজ জেঠিমা আর ছোট ফুপু লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরায় ব্যাস্ত আম্মাও আলমারি থেকে লাল পেড়ে গরদের শাড়িটা বের করলো আর আমাকে একটা সাদা ফ্রক দিলো পরিয়ে তখনও জানিনা এমন অন্ধকারে সেজে গুজে কোথায় চলেছি ! সবার সাজগোজ সারা হতেই বেরিয়ে পরলাম!

গেইটের বাইরে যেয়ে দেখলাম দুটো রিকশা দাঁড়িয়ে আছে ! রাতেই বলা ছিলো বোধ হয় আমাদের বাড়ি ছিলো পুরান ঢাকায় ! বাড়ির উল্টো পাশেই বড় একটা রিকশার গ্যারেজ ছিলো আম্মা আর চাচী উঠলো এক রিকশায় , অন্যটায় আমি আর ছোট ফুপু ! গন্তব্য কোথায় জানিনা , তবে মনে মনে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম এটাতো বলার অপেক্ষা রাখেনা খালি রাস্তায় রিকশা ছুটে চলেছে ! ফুপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন

বললাম : আমরা কোথায় যাচ্ছি ফুপু ?

ফুপু হেসে বললেন , এটাইতো সারপ্রাইজ ! আগে থেকে বলে দিলে মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে

ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি আমরা ! তখনও আলো ফোটেনি ! দেখলাম রমনা পার্কের গেইট এর সামনে এসে  রিকশা থামলো ভাবলাম , এটা কোনো সারপ্রাইজ হলো? এই পার্কে তো আব্বা আম্মার সাথে কতোবার এসেছি

যাই হোক হেঁটে গিয়ে বটতলায় যখন পৌঁছুলাম তখন দেখলাম ছায়ানটের যতো চেনা মানুষেরা সব লাল সাদা শাড়ি আর পাঞ্জাবী পায়জামা পরে সারি বেঁধে বসে আছে সমস্ত বাদ্য যন্ত্র নিয়ে আমার আম্মা , ফুপু এবং চাচী তিনজনই ছায়ানটের ছাত্রী ! আম্মা আমাকে প্রায়ই সাথে  নিয়ে যান ওঁদের যখন ক্লাস চলতো তখন  আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম, ওখান থেকেই আমার গান শেখার আগ্রহ তৈরী হয়  

যাই হোক , আমি সব দেখে শুনে যারপরনাই আপ্লুত ! আমাকে আম্মা দর্শক সারির একদম সামনে বসিয়ে দিলেন আর বার বার শাঁসালেন যেনো কোনো ভাবেই জায়গা ছেড়ে না উঠি আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম দেখলাম আমাকে দর্শক সারিতে বসিয়ে দিয়ে ওরা তিনজনও আসন গ্রহন করলেন স্টেজে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে এতোক্ষনে সারপ্রাইজটা ধরতে পারলাম মনে মনে কি যে আনন্দ হচ্ছিলো আমার পরিবারের সবাই আজ গান গেয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে অন্য সবার সথে !

এসো হে বৈশাখ গানটি দিয়ে শুরূ হয়ে গ্যালো বর্ষ বরণের অনুষ্ঠান একটা কমলা রঙের নরম আলো ছড়িয়ে বছরের নতুন সূর্য উদিত হলো যখন তখন পেছনে তাকিয়ে দেখি শত শত লোকের ভিড় জমে গ্যাছে ।  

লাল সাদার কেতন উড়ছে তখন সারা রমনা পার্ক জুড়ে এমন ভোর এর আগে কোনোদিন দেখিনি আমি

অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন পার্কের ভেতর মেলা বসেছে নানা রকম মাটি দিয়ে তৈরী খেলনা , পুতুল আর বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা পাখি আর বাঁশির ওখান থেকে মাটির পুতুল আর খেলনা কিনে এক রাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন

আমার জন্মেরও অনেক বছর আগে থেকে অর্থাৎ ১৯৬৫ সাল থেকেই ছায়ানটের এই বর্ষ বরন অনুষ্ঠান শুরূ হয় পরবর্তী কালে আমিও রমনার বটমূলে বসে কতোবার যে গান গেয়ে ছায়ানটের শিল্পীদের সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি তার হিসেব নেই কারন আমি সাত বছর বয়সেই ছায়ানটে ভর্তি হই তারপরের গল্প ইতিহাস আশির দশকে চারুকলার মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রথমটিতে অংশ নিয়েছিলাম পান্তা ভাত , ইলিশের স্টলগুলোও তখন থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরূ করলো

পহেলা বৈশাখের সেই বোমা বিস্ফোরণেরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমি তখন আমার বড় মেয়ে জয়িতা খুব ছোট ওকে খাইয়ে দাইয়ে আম্মার জিম্মায় রেখে আমি, আমার বর আর ভাইদের সাথে গেলাম বটমূলের বর্ষবরন অনুষ্ঠান দেখতে  কিছুক্ষণ অনুষ্ঠান দেখেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ছোট বাচ্চা বাসায় রেখে এসেছি একারনেই বের হয়ে আসলাম রমনা পার্কের গেইট পর্যন্ত আসতেই পেছন থেকে বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দ কানে এলো থেমে গেলো গান কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম আমরা চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি , আর্তনাদে ভরে উঠেছিলো সেদিনের আকাশ

পেছন থেকে কেউ একজন বলছে ..পালান , ওরা বোমা মেরেছে

আমরাও উদভ্রান্তের মতো জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম মনে হলো আমার ছোট্ট মেয়েটাই যেনো বাঁচিয়ে দিয়েছিলো আমাদের ওর জন্যই আমরা আর্লি ফিরে যাচ্ছিলাম বাসায় তখন আমাদের পাশ দিয়েই ভ্যানে করে রক্তাক্ত আহত মানুষদের নিয়ে যাচ্ছিলো ঢাকা মেডিকেলে

সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ! না,  আজ এই বর্ষবরণের প্রাক্কালে সবার মন খারাপ করে দেয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না আমার ।  এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যেনো কারো জীবনে কখনও না হয়, আর এর পুনরাবৃত্তিও যেনো না হয় এটাই কামনা নতুন বছর সবার জীবনে নিয়ে আসুক এক নতুন প্রভাত

Exit mobile version